গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে কক্সবাজার ছেড়ে যাওয়া ঢাকাগামী আইকন পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা হামলার এক বছর আজ। সেদিন প্রাণ হারায় আটজন যাত্রী এবং দগ্ধ হন অনেকে। তন্মধ্যে ছিলেন কক্সবাজারের চকরিয়ার আবু তাহের, রাশেদুল ইসলাম বাদশা ও মোহাম্মদ ইউছুফ। সংসারের একমাত্র উপার্জক্ষম এই তিন ব্যক্তিকে অকালে হারিয়ে পথে বসেছে তাদের পরিবার। বলতে গেলে এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। পেট্রোল হামলায় নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের আজ একবছর পূর্ণ হলেও সরকারী এককালীন অনুদান হিসেবে এক টাকাও জোটেনি এই তিন পরিবারে। এতে চরম অর্থকষ্টে ও হতাশায় দিন কাটছে পরিবারের সদস্যদের। হতভাগা তিনজনের রেখে যাওয়া সন্তান–সন্ততিদের পড়ালেখা করানো দূরে থাক ঠিকমতো একবেলা খাবারও দিতে পারছেনা তাদের মায়েরা। তার ওপর ঋণের বোঝা মাথায় থাকায় দেউলিয়া হওয়ার মতো পরিস্থিতি এই তিন পরিবারে।
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রোল হামলার পর পরই দেশের মানুষ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিবেক নাড়া দিলে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দৌঁড়ঝাপ বেড়ে যায়। ওইসময় কয়েকদিন এই তিন পরিবারের শুধুমাত্র খোঁজ–খবর নিলেও এখনো পর্যন্ত কোন আর্থিক সহায়তা না পাওয়ায় অভাব পিছু ছাড়ছেনা পরিবার সদস্যদের। তিন পরিবারের প্রতিটি সদস্যের চোখে–মুখে হতাশার ছাপ। গতকাল দুপুরে এই প্রতিবেদক সরজমিন পরিদর্শনের গেলে স্বজন হারানোর বেদনায় এ সময় কেউ কেউ ডুকরে কেঁদে ওঠেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করেছেন পরিবারের সদস্যরা। এই তিন পরিবারের দাবি, যেসব রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় আজ এসব পরিবারের রুটি–রুজির পথ বন্ধ হয়ে গেছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি পেট্রোল বোমায় নিহতদের জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত তহবিল থেকে এককালীন অনুদান দেওয়া। তা না হলে সংসারের ভরণ–পোষণ চলাতে কষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ঋণের বোঝা নিয়ে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম এই তিন পরিবার।
উল্লেখ্য, পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ফেরাতে কাতার যাওয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাতে চকরিয়া থেকে আইকন পরিবহনের একটি বাসে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন হারবাং ইউনিয়নের গাইনাকাটা গ্রামের ছিদ্দিক আহমদের পুত্র আবু তাহের (৪৫)। ওইবাসে ছিলেন একই পাড়ার ছালেহ আহমদের পুত্র মোহাম্মদ ইউছুফ (৫৫) ও বরইতলী ইউনিয়নের দক্ষিণ গোবিন্দপুর গ্রামের ছৈয়দ আহমদের পুত্র রাশেদুল ইসলাম বাদশা (৩০)। কিন্তু ৩ ফেব্রুয়ারি ভোররাত তিনটার পর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় পুরো বাসে আগুন ধরে গেল হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ সময় ঘটনাস্থলেই দুইজন এবং বাদশা ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারান।
কাতারগামী আবু তাহেরের স্ত্রী নুরজাহান বেগম বলেন, দুই কানি চাষের জমি ছিল স্বামীর। বিদেশ যাবে তাই ওই জমি বিক্রি করে এবং বসতভিটে বন্ধক রেখে দুই লাখ টাকা যোগাড় করি। সেই টাকার পাশাপাশি স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে পরিবারের ভবিষ্যত চিন্তা করে স্বামী কাতারের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে রওনা দেন। তিনি চকরিয়া থেকে বাসে করে ঢাকায় যাচ্ছিলেন ৩ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে বিমানে ওঠার জন্য। কিন্তু পেট্রোল বোমায় ছারখার হয়ে গেল আমাদের সেই স্বপ্ন। নুরজাহান আরো বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার ইতোমধ্যে একবছর হয়ে গেল। এই সময়ে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে ও আত্মীয়–স্বজনদের দেওয়া টাকায় সংসারও ঋণের বোঝা মাথায় রয়েছে। তার ওপর একমাত্র ছেলে শোয়াইবুল ইসলাম ইমনের পড়ালেখা বন্ধ রয়েছে অর্থাভাবে। মেয়ে নাঈমা সুলতানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। স্বামী কাতার যেতে জমি বিক্রির পাশাপাশি দেড় লক্ষ টাকায় বন্ধক রাখা বসতভিটা এখনো মুক্ত করতে পারিনি। এখন সুদে–আসলে ওই টাকা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় পরিবারের ভরণ–পোষণ চালাব না–কি ঋণের বোঝা পরিশোধ করব তা নিয়ে হতাশায় ভুগছি। নুরজাহান অভিযোগ করেন, কাতার যাওয়ার জন্য আমার স্বামী বরইতলী শান্তিবাজার এলাকার মো. শওকত ও মানিক নামের দুই ব্যক্তিকে যে টাকা দিয়েছিল তার মধ্যে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা এখনো তারা ফেরত দেয়নি। যদি ওই টাকাগুলো পেতেন তাহলে বন্ধক রাখা বসতবাড়িটি মুক্ত করতে অনেকটা সহায়ক হতো।
রাশেদুল ইসলাম বাদশার স্ত্রী সুমি আক্তার বলেন, আবু তাহেরের সঙ্গে কাতার যেতে আমার স্বামী বাড়ি বন্ধক রেখে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকাসহ ৩ লক্ষ ২০ হাজার টাকা যোগাড় করেছিল। এখন এত ঋণের বোঝা নিয়ে কিভাবে বাঁচব তা আমার বুঝে আসে না। তার ওপর ছেলে রাফিদুল ও ফাহিমের ভবিষ্যতও অন্ধকার দেখছি। কেউ আমাদের পাশেও দাঁড়াচ্ছেনা। এই অবস্থায় দেউলিয়া হওয়ার মতো পরিস্থিতি আমাদের। রাশেদের মা সালমা খাতুন বলেন, আমার নাতি–নাতনীরা এখনো ছোট। তাই তারা মনে করছে তাদের বাবা ফিরে আসবে। মাঝে–মধ্যে আমার কাছে প্রশ্ন করে তাদের বাবা কখন আসবে, কখনো যে বাবা আসবে না তা আমি কি করে বলি তাদের? এসব কথা বলতেই চোখের পানি ছেড়ে দেন নিহত রাশেদের মা সালমা খাতুন। নিহত ইউছুফের স্ত্রী ফরিদা খাতুন বলেন, আমার স্বামী বিদেশ যেতে রাজি ছিল না। আমিই তাকে কাতার পাঠানোর জন্য টাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। এখন আমি সন্তানদের নিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছি। তার ওপর ঋণের বোঝা ঘাড়ে চেপে বসে থাকায় চোখে–মুখে অন্ধকার দেখছি।
জানা গেছে, সেসময় কাতারগামী ইউছুফের সঙ্গে ঢাকায় যাচ্ছিল তার ছোট ভাই মো. হানিফ। সেও পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ও প্লাষ্টিক সার্জারি ইউনিটে যথাযথ চিকিৎসা পেয়ে বেঁচে যায়। তবে হানিফ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত তহবিল থেকে এককালীন ১০ লক্ষ টাকার ডিপোজিট থেকে প্রতিমাসে এখন নগদ ১০ হাজার ৭০০ টাকা হিসেবে অনুদান পাচ্ছেন। কিন্তু নিহত তিনজনের দাফন–কাফনসহ তাৎক্ষণিক ব্যয় নির্বাহের জন্য তিন পরিবার শুধুমাত্র পায় দুই দফায় ৪০ হাজার টাকা ও ৩০ কেজি করে চাল। এর পর সরকারিভাবে এককালীন কোন অনুদান পায়নি নিহত তিনজনের পরিবার। এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাহেদুল ইসলাম বলেন, কুমিল্লায় পেট্রোল বোমায় নিহত তিনজনের পরিবারকে তৎসময় কুমিল্লা ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুই দফায় ৪০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও ৩০ কেজি করে প্রতি পরিবার চাল পায়। এর পর তাদের এই তিন পরিবারকে দেওয়ার জন্য কোন অনুদান আমার দপ্তরে আসেনি।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, সরকার উৎখাতে কথিত আন্দোলনের নামে রাতের আঁধারে বিএনপি–জামায়াতের ছোঁড়া পেট্রোল বোমার আগুনে নিহত তিনজনের পরিবার যাতে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন সেজন্য আমার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যক্তিগতভাবে আমি তিন পরিবারকে আর্থিক সহায়তাও করেছি। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত এককালীন অনুদানের আওতায় তিন পরিবারকে নিয়ে আসার জন্য আমি তৎপর রয়েছি।
পাঠকের মতামত: